ঔষধ ও মাদকদ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য, মাদকদ্রব্য গ্রহণের মাধ্যম, তামাক ও মাদকদ্রব্য সেবনের কুফল, ধূমপান ও মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকার উপায়, মাদকমুক্ত থাকার ক্ষেত্রে অন্যদের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত বর্ননা করা হল।
![]() |
| মাদকদ্রব্য - ঔষধ ও মাদকদ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য । মাদকদ্রব্য সেবনের কুফল ও বিরত থাকার উপায় গুলো কি কি? |
মাদকাসক্তি, তামাক ও মাদকদ্রব্য এবং তামাক ও মাদকদ্রব্য সেবনের কুফল
মাদকাসক্তি বলতে মাদকদ্রব্যের প্রতি প্রচণ্ড আসক্তি বা নেশাকে বােঝায়। যে সব দ্রব্য সেবন বা পান করলে তীব্র নেশার সৃষ্টি হয় সেগুলাে মাদকদ্রব্য। কোনাে কোনাে ঔষধকে ব্যবহারগত কারণে মাদকদ্রব্য বলা হয়। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনাে ঔষধ অতিরিক্ত সেবন করলে এবং এর প্রতি আসক্তি জন্মালে সেটাও মাদকদ্রব্যের আওতায় পড়ে। অতএব যেসব দ্রব্য সেবন করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে এবং সেগুলাের প্রতি সেবনকারীর প্রবল আসক্তি জন্মে সে সব দ্রব্যকে মাদকদ্রব্য বলে। যেমন- বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, মদ, গাজা, ভাং, হেরােইন, আফিম, পেথিডিন, ফেনসিডিল, ঘুমের ঔষধ ইত্যাদি। যারা মাদকদ্রব্য সেবন করে মাদকদ্রব্যের প্রতি তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হয়। তারা মাদকদ্রব্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে পারে না। যদি কোনাে কারণবশত তারা মাদক গ্রহণ করতে না পারে তাহলে তাদের মধ্যে মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক উপসর্গের সৃষ্টি হয়। যেমন- মেজাজ খিটখিটে হয়, ক্ষুধা ও রক্তচাপ কমে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়, নিদ্রাহীনতা দেখা দেয়, আচরণে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে।
ঔষধ ও মাদকদ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য
ঔষধ ও মাদকদ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য নিচে দেওয়া হল:
- ঔষধ সেবন করলে রােগমুক্তি ঘটে, মাদক সেবনে শরীরের নানা রােগের সৃষ্টি হয়।
- ঔষধ গ্রহণের মাত্রা নির্ধারিত থাকে, মাদকের মাত্রা নির্ধারিত থাকে না।
- অসুখ সেরে গেলে ঔষধ খাওয়ার প্রয়ােজন হয় না, কিন্তু মাদকে আসক্ত হলে সহজে ছাড়া যায় না।
বাংলাদেশে যে সকল মাদকদ্রব্য প্রচলিত আছে সেগুলাে হলাে হেরােইন, আফিম, পেথিডিন, ফেনসিডিল, গাঁজা জাতীয় মারিজুয়ানা, ভাং, চরস, ইয়াবা এবং ঘুমের ঔষধ, মদ এবং তামাক জাতীয় মাদকদ্রব্য। তামাক গাছের পাতা থেকে তামাক জাতীয় মাদকদ্রব্য তৈরি হয়। তামাক পাতায় নিকোটিন থাকে যা এক ধরনের মাদক। তামাক পাতা দিয়ে বিড়ি, সিগারেট, চুরুট,পানের জর্দা, গুল, নস্যি ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
মাদকদ্রব্য গ্রহণের মাধ্যম
যারা মাদকসেবী তারা নানা পদ্ধতি ও মাধ্যমে মাদকদ্রব্য সেবন করে। যেমন ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানাে, ট্যাবলেট, পাউডার বা সিরাপ হিসেবে খাওয়া, পানীয় হিসেবে পান করা, ধূমপানের মাধ্যমে গ্রহণ করা। ধূমপানেরও আবার নানা ধরন আছে। যেমন-সিগারেট, বিড়ি, চুরুট, হুঁকা ইতাদি।
তামাক ও মাদকদ্রব্য সেবনের কুফল :
তামাক ও মাদকদ্রব্য সেবন বলতে প্রধানত ধূমপানকে বােঝায়। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে পৃথিবীতে প্রতি ৮ সেকেন্ডে শুধু ধূমপানজনিত কারণে একজন ব্যক্তির মৃত্যু হচ্ছে। যারা ধূমপান করে তারা ও ধূমপায়ী ব্যক্তির ছেড়ে দেওয়া ধোয়া থেকে অন্যরা নানা রােগে আক্রান্ত হচ্ছে। মাদকদ্রব্য সেবনের কুফলসমূহ হচ্ছে
- মাদকদ্রব্য মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। যেমন- শেখার ও কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস করে, চাপ সহ্য করার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে ব্যাহত করে। তাছাড়া মানসিক পীড়ন বাড়িয়ে দেয়।
- পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে যন্ত্রণাদায়ক প্রভাব ফেলে। মাদকসেবী পরিবারের সদস্যদের সাথে উগ্র আচরণ করে, পরিবারের শান্তি বিনষ্ট করে।
- শারীরিক সুস্থতার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। মাদকদ্রব্য সেবন মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষকে ধ্বংস করে, খাদ্যাভ্যাস নষ্ট করে, চোখের দৃষ্টিশক্তি কমিয়ে দেয়।
- কিছু কিছু মাদক এইচআইভি ও হেপাটাইটিস-বি-এর সংক্রমণের আশংকা বাড়িয়ে দেয়। খাদ্যনালি ও ফুসফুসের ক্যান্সার, কিডনির রােগ, রক্তচাপ প্রভৃতি বহুবিধ রােগের সৃষ্টি করে।।
- আর্থিক ক্ষতি হয়। নেশার টাকা যােগাতে গিয়ে সংসারে অভাব ও অশান্তির সৃষ্টি হয়।
ধূমপান ও মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকার উপায় এবং এ সম্পর্কে অন্যদের ভূমিকা :
ধূমপান ও মাদকদ্রব্য সেবনের কুফল সম্পর্কে পূর্ববর্তী পাঠে বিস্তারিত আলােকপাত করা হয়েছে। কিন্তু সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য বিষয়টি সম্পর্কে শুধুমাত্র জানাই যথেষ্ট নয়। মানুষের জীবনের জন্য ক্ষতিকর এমন মারাত্মক অভ্যাসটি যাতে ত্যাগ করা যায় সেজন্য এখনই সে বিষয়ে বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য প্রথমই দরকার কোনাে অবস্থাতেই ধূমপানসহ অন্য কোনাে মাদকদ্রব্য গ্রহণ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। কারণ কিশাের-কিশােরীদের বয়ঃসন্ধিকালে অজানা বিষয়ের প্রতি প্রচণ্ড কৌতূহল থাকে। এই কৌতূহল ও উত্তেজনাবশে কিংবা বন্ধুবান্ধবসহ কারাে দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা ধূমপান বা মাদক সেবন করতে পারে।
এই কৌতূহল বা উত্তেজনা সারা জীবনের জন্য তার অনুশােচনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই কৌতূহল মিটাবার পূর্বে ঐ কিশাের বা কিশােরীকে ভাবতে হবে ধূমপান বা মাদক সেবনের ফলে কী কী কুফল দেখা দেবে এবং এই কুফলসমূহ বিবেচনা করলে তার মাদক সেবন করা উচিত হবে কি না।
ধূমপান ও মাদক সেবন থেকে বিরত থাকতে হলে নিচের ধারাবাহিক কার্যক্রমগুলাে অনুসরণ করতে হবে। যেমন
- ধূমপান ও মাদক সেবনের ফলে কী অবস্থা হয়, প্রথমে তা মনে মনে ভাবতে হবে।
- ধূমপান বা মাদক সেবনের ফলে মা-বাবা, ভাই-বােন বা অভিভাবক এক অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়বেন, লজ্জিত হবেন। শিক্ষকেরা বিষয়টিকে ভালােভাবে গ্রহণ করবেন না। এ অবস্থা যাতে না হয় সেজন্য ভাবতে ও বিবেচনা করতে হবে।
- এরপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মনস্থির করবে। ধূমপান বা মাদক সেবন না করার বিষয়ে প্রথমেই দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে পারলে এই সর্বনাশা কাজ থেকে বিরত থাকা যায়।
- সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রথমে পরিস্থিতি, সমস্যা, বিপদ চিহ্নিত করে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এই তথ্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা অন্য কোনাে সূত্রে সংগ্রহ করতে হবে। তথ্যের প্রেক্ষিতে করণীয় সমাধান চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে হবে।
- ধূমপান ও মাদক সেবন থেকে শুধু নিজে বিরত থাকলে চলবে না, বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী, পরিচিতজনকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে তারা যেন এই মারাত্মক নেশা থেকে দূরে থাকে।
- মাদকদ্রব্য সেবনের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর দিক জেনে সবার উচিত এ থেকে নিজে মুক্ত থাকা, বন্ধু-বান্ধব ও অন্যদেরকে এর কবল থেকে মুক্ত থাকতে অর্থাৎ মাদকদ্রব্য গ্রহণ করা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করা।
মাদকমুক্ত থাকার ক্ষেত্রে অন্যদের ভূমিকা :
মাদকাসক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে মাদকাসক্ত বন্ধু-বান্ধবদের ক্ষতিকর। প্রভাব বেশ বড় ভূমিকা পালন করে। তবে সব কধুই কি মাদকাসক্ত, নিশ্চয়ই না। দু'একজন হয়ত দুর্ভাগ্যক্রমে। মাদকাসক্ত হয়, তবে বেশির ভাগ কধুই ভালাে হয়। এই ভালাে বন্ধুরাই অন্য বন্ধুদেরকে মাদক গ্রহণ না করার জন্য প্রভাবিত করতে পারে। মাদকমুক্ত থাকার ক্ষেত্রে কধু বা সমবয়সী ছাড়াও আরও অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন- সন্তানের প্রতি অভিভাবকের সতর্ক দৃষ্টি সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখে। এছাড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষকের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষক আদর্শস্বরূপ। শিক্ষকের আদেশ ও উপদেশ শিক্ষার্থীরা আন্তরিকভাবে পালন করে। শ্রেণিকক্ষে বা শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষকের আদেশ ও উপদেশে। শিক্ষার্থীরা মাদক পরিহার করে চলতে পারে। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরাও স্নেহ, ভালােবাসা ও আন্তরিকতা দিয়ে। ছেলেমেয়েদের মাদকমুক্ত থাকতে সাহায্য করতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম যেমন- পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন মাদক বিরােধী প্রচারণা চালিয়ে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে। এর বাইরে। আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেও মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে তােলা যায়।


